নঈম নিজাম : সেদিন একজন এমপির সঙ্গে দেখা হলো। দম্ভ নিয়ে বললেন, ভাই, টানা দুবারের এমপি। আরেকজন বললেন, সেই ২০০৮ সাল থেকে তিনবার সংসদে আছি। হাসলাম। জবাবে বললাম, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের এমপি হয়ে গর্ব করার কিছু নেই। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে সংসদে ছিলেন কি? না থাকলে জেনে নিন, সেই কঠিন দিনের বিজয়ীরাই সত্যিকারের নেতা। আওয়ামী লীগের টিকিটে ১৯৭৯ ও ’৮৬ সালের ভোটে সামরিক সরকারের প্রতিকূলতা ও ভোট ডাকাতি মোকাবিলা করেও অনেকে জয়ী হয়েছেন। তাদের অনেকে এখনো সংসদে আছেন। কোনো অহংকার নেই। অহমিকা নেই। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার এক ধৈর্যের ধারাবাহিকতা হলো রাজনীতি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালে অনেক তারুণ্যকে টেনে এনেছেন। তাদের ছয়জন এখনো সংসদে আছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা তাদের সম্মান দিয়ে রেখেছেন। নৌকার টিকিটে ’৯১ সালে নুরে আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী) ও মীর্জা আজমকে সবচেয়ে কম বয়সে সংসদে নিয়ে এসেছেন শেখ হাসিনা। টানা ছয়বার বিজয়ের রেকর্ড গড়ে আজ তারা জাতীয় নেতা। লিটন চৌধুরী অনেক বড় সংগঠক। নিজের নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বদলে দিয়েছেন একটি অঞ্চলকে। একইভাবে এগিয়ে চলেছেন মীর্জা আজম। শুধু জামালপুর নয়, ময়মনসিংহ অঞ্চলে তাঁর অবস্থান প্রশংসিত। সবাই তাঁদের মতো হতে পারেননি। হবেনও না। শুধু নেতা হলে চলে না। নেতৃত্বের গুণও থাকতে হয়। ‘জীবন ঘষে আগুন’ সবার ভিতর থাকে না। অনেকে ক্ষমতার ভার সইতে পারেন না। ক্ষয়ে যান। ঝরে যান। তৃণমূলের একজন মাঠের নেতাকে জানি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তাঁকে সেই ’৯৬ সাল থেকে মূল্যায়ন করছেন। ২০০১ সালে বিজয়ী হতে পারেননি। তার পরও গত তিন মেয়াদের ক্ষমতায় দুবার পতাকাও উড়িয়েছেন গাড়িতে। অতি লোভে পড়ে তাঁতিও নষ্ট হয়। এই ভদ্রলোকও এখন টাকা ছাড়া কিছু বোঝেন না। মন্ত্রী থাকতে অনেক করেছেন। অভিযোগের পাহাড়ে বাদ পড়েছেন। এখন করছেন কমিটি বাণিজ্য। টাকা নিয়ে বিএনপির লোকজনকেও কমিটিতে নেন! হাওয়া ভবনের পার্টনারকে দলে দেন ঠাঁই। কেন এমন করেন জানি না।
আগে নেতা তৈরি হতো মাঠে-ময়দানে। মূল্যায়ন হতো দলের প্রতি সততা, নিষ্ঠা, অবদান ও আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা দেখে। এখন নেতা তৈরি হয় এমপি-মন্ত্রীদের ড্রয়িংরুমে। দলের জন্য অবদানের দরকার নেই। ঘাটে ঘাটে টাকা-পয়সা দিলেই চলে। একটা সময় ভোটে জিততে কর্মী লাগত। এখন শুধুই প্রতীক। রাজশাহীর এক এমপির বিরুদ্ধে দলের ভিতরে অভিযোগের পাহাড়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ তাঁর বিরুদ্ধে যখন তখন সংবাদ সম্মেলন করে। অনশন করে। ক্ষোভ-বিক্ষোভ, প্রতিবাদ জানায়। কেন্দ্রের কাছে পাঠায় লিখিত অভিযোগ। তাদের একটাই দাবি- এই এমপি সাহেবকে আর দেখতে চাই না ভোটের মাঠে। অন্য কাউকে মনোনয়ন দিন আগামী নির্বাচনে। শতভাগ বিজয়ী করে আনব। শুধু রাজশাহী নয়, সারা দেশে বিতর্কিত, দলবিচ্ছিন্ন এমপির সংখ্যা বেড়েছে। সংগঠনের ভাবমূর্তিতে তাদের কিছু যায়-আসে না। শেখ হাসিনার নির্দেশের প্রতি সম্মান নেই। দলের নীতি-আদর্শ মেনে চলেন না। দাম্ভিকতা নিয়ে চলেন। চলনে-বলনে রাজনীতির বালাই নেই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শিষ্টাচার নেই। যা খুশি তা করেন। বুঝেও বোঝেন না তাঁদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের অনল খোদ আওয়ামী লীগেই জ্বলছে। অতিষ্ঠ হয়ে আছেন নেতা-কর্মীরা। সুযোগ পেলেই কর্মীরা কষবে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। প্রশ্ন করবে, কেন এলাকায় ঠিকভাবে যান না। মানুষের পাশে দাঁড়ান না। ভোট এলে জবাব দিতে হবে। সব দায় কেন্দ্রের না। হাশরের ময়দানে সবাই ইয়া নাফসি করবে। যার যার হিসাব তার তার। দলের কাছে, কর্মীর কাছে হিসাব দিতে হবে। তৈরি করতে হবে ভোটে নামার পরিবেশ। সারা বছর তৈরি করা ভাই লীগ, এমপি লীগে কাজ হবে না শেষ মুহূর্তে। জবাব দিতে হবে নিজের পরিবারের সদস্যদের ছবি পোস্টারে দেওয়ার। বিশাল বিলবোর্ডে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হয় জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি। দূর থেকে দেখা যায় এমপি সাহেব ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবি। সবকিছুরই জবাবদিহি আছে।
রাজনীতিকে তার মতো করে চলতে দিতে হবে। জনগণের আস্থা অর্জন করতে হলে মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। দুই দিনের ক্ষমতার দুনিয়ায় দাম্ভিকতা থাকলে চলবে না। অহংকারের পতন আছে। প্রতি বছরই মনোনয়নের সময় একদল লোক বিদায় নেয়। আরেক দল নতুন করে ঠাঁই পায়। আমলনামা নিয়ে বেলা শেষে দলীয় সভানেত্রী বসেন। তিনি হিসাব-নিকাশ করেন। যোগ্যদের মূল্যায়ন করেন। দুঃসময়ের মানুষদের কাছে টেনে নেন। বর্তমান ও আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাকে দেন গুরুত্ব। শেখ হাসিনাই শেষ বেলায় ভরসা। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ ৫২ বছরে একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের উন্নতি-সমৃদ্ধির প্রশংসা হচ্ছে সারা বিশ্বে। বঙ্গবন্ধুকন্যার দূরদর্শিতায় বাংলাদেশের আজকের অবস্থান। এ অবস্থানকে খাটো করার অধিকার কারও নেই। কিছু মানুষের ব্যর্থতার খেসারত গোটা আওয়ামী লীগ কেন দেবে? শেখ হাসিনার সততা, নিষ্ঠা, উন্নয়ন ও কর্মীদের আগলে রাখার গতির সঙ্গে যারা খাপ খাওয়াতে পারেননি তাদের আলাদা করতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে অনেককে ছেঁটে ফেলতে হবে ভোটের মাঠ থেকে। শুনেছি, আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন থেকে বাদ পড়বেন এক শর বেশি এমপি। জানি না সেই এমপিরা কারা। তবে এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবমুখী ও সঠিক। বিতর্কিত, কর্মীবিচ্ছিন্নদের বারবার মনোনয়ন দেওয়ার কোনো মানে নেই। আওয়ামী লীগ করতে হলে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ ধারণ করতে হবে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক, সামাজিক দর্শনকে পালন করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে না বুঝলে কীসের আওয়ামী লীগ? মুজিববাদ শুধু একটি ধারণা নয়, একটি দর্শন। এই দর্শনকে আধুনিকায়ন করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি ইতিহাসের গভীরতায় প্রবেশ করেছেন। তাঁর কর্মদক্ষতায় আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায়। এখানে অন্য কারও গর্ব, অহমিকা দেখানোর কিছু নেই। শেখ হাসিনা না তাকালে তারকা রাজনীতিবিদও অস্তিত্বহীন হতে সময় লাগে না। নক্ষত্রের পতন হয় মুহূর্তে।
আওয়ামী লীগের আজকের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সময় লেগেছে। হুট করে কিছু হয়নি। ১৯৮১ সালে দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর ঘরে-বাইরে একাই লড়েছেন শেখ হাসিনা। টিম ছিল। সেই টিমের সদস্যদের কেউ খাপ খাওয়াতে পারলে টিকে থেকেছেন। না পারলে ছিটকে পড়েছেন। যুদ্ধ থামাননি তিনি। ভাত ও ভোটের অধিকারের লড়াই করেছেন। রাজনীতিকে স্বচ্ছতায় আনতে ড. কামাল হোসেন গংদের তৈরি করা বাধা সামাল দিয়েছেন। পথে হেঁটেছেন সুশীলদের বিছিয়ে রাখা কাঁটা পরিষ্কার করে। ধৈর্য ও সহনশীলতা নিয়ে সামলেছেন সবকিছু। তৈরি করেছেন উন্নয়ন সমৃদ্ধির নতুন ইতিহাস। এখন সারা দেশের মানুষকে আঙুল উঁচিয়ে অনেক কিছু দেখাতে হয় না। বঙ্গবন্ধুকন্যার সব কাজের স্বচ্ছতা দৃশ্যমান। শেখ হাসিনা নিজেই একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের ওপর ভর দিয়ে আগামী নির্বাচন করতে হবে আওয়ামী লীগকে। প্রস্তুতি রাখতে হবে একটি ভালো নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের। বিশ্বাস করি, মানুষের আস্থার শেষ ঠিকানা হিসেবে শেখ হাসিনা আবারও ক্ষমতায় আসবেন। আওয়ামী লীগ তৈরি করবে নতুন ইতিহাস। সেই ইতিহাসের কারা সঙ্গী হবেন, তা বোঝা যাবে আগামী নির্বাচনের মনোনয়নে। ৩০০ আসনে শেখ হাসিনা ভোট করলে চিন্তার কিছু নেই। বাকিদের বিষয়ে হিসাবের খাতা দেখেই করতে হবে মূল্যায়ন। এটা সত্য, কিছু এমপি নিজের অবস্থান হারিয়েছেন। টিআর, কাবিখা মেরে দেওয়া এমপিদের মানুষ ভোট দেয় না। শিক্ষক, দফতরি, পিয়ন নিয়োগে অর্থ গ্রহণকারীদের প্রতি মানুষের আস্থা থাকে না। উন্নয়ন করেননি, কর্মীদের খোঁজ নেননি- তাদের প্রতি থাকে না বিশ্বাস। পরিবারতন্ত্র কায়েমকারীদের প্রতি কর্মীরা বিরক্ত, ব্যথিত। শক্ত একটা ভোটের কথা মাথায় রেখেই দিতে হবে মনোনয়ন।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে সব ধরনের লোক আছে, থাকবে। বড় দল হিসেবে আছে বিভেদও। বঙ্গবন্ধু তিল তিল করে এই দলকে তৈরি করেছেন। আদর্শ, নীতি, সততা, নিষ্ঠায় চালিয়েছেন দল। পুরো জীবনের বড় অংশই কাটিয়েছেন কারাগারে। নীতির প্রশ্নে শেখ হাসিনাও আপস করেননি। এখনো করছেন না। করছেন না বলেই এই দল আজকের শক্ত অবস্থানে। আদর্শের রাজনীতির বারোটা বাজিয়েছেন সামরিক শাসকরা। দল করতে গিয়ে ন্যায়নীতির তোয়াক্কা করতেন না। দল বদলের রাজনীতিও চালু করেন সামরিক শাসকগুলো। অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে তারা রাজনৈতিক দল গড়তেন। তারপর সেই দলে ভেড়াতেন বিভিন্ন দলের নেতাদের। ডেকে এনে মন্ত্রী-এমপি করতেন। দলীয় পদ দিতেন। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ আমলে এমন কাণ্ডই হয়েছিল। বিকালে সরকারবিরোধী মিছিল করে সন্ধ্যায় শপথ নিতেন অনেক নেতা। বেতার-টিভিতে সেই খবর শুনে বিব্রত হতেন কর্মীরা। সিরাজুল হোসেন খান শ্রমিক রাজনীতি করতেন। বাম চিন্তার মানুষটি আন্দোলনের মাঠ থেকেই বঙ্গভবনের গাড়িতে চড়েছিলেন এরশাদ জমানায়। সামরিক সরকারের শপথ তালিকায় পেশাজীবীরাও ছিলেন। তারাও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সমান্তরাল পাল্লা দিতেন। দিনে সরকারবিরোধী বক্তৃতা দিয়ে মাঠ গরম করে রাতে বঙ্গভবনে জিলাপি খেতেন। কবিরা বসাতেন কবিতার আসর। ব্যুরোক্র্যাটরা অবসর নিয়েই পেতেন পুরস্কার। রাজনীতিবিদদের কোনো আগামাথা থাকত না। কোরবান আলী আওয়ামী লীগের মিছিল থেকে গিয়ে শপথ নিয়েছিলেন। দল থেকে পদত্যাগের সময়ও পাননি। তিনি অবশ্য তখন বলেছিলেন, মুন্সীগঞ্জের রাজনীতিতে শাহ মোয়াজ্জেমের বাড়াবাড়ির কারণেই তাঁকে দল বদল করতে হয়েছিল। এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে একটা অজুহাত তো লাগবেই। হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্রের বিপরীতে একজন খালা আছেন। এই খালার বাড়িতে গিয়ে হিমু দেখতেন খালুজান একটা অজুহাত তৈরি করে মদের বোতল খুলছেন। হিমুর কাছে দুঃখ নিয়ে সেই অজুহাতের কথা বলতেন। সামরিক শাসকদের রাজনীতিও তেমন ছিল। একটা অজুহাত লাগত তাদের। এ অজুহাতে কখনো বঙ্গভবন নিয়ন্ত্রণে নিত তারা। আবার কখনো রাজনীতিকে করত জটিল। প্রতিদিন ভিতরে-বাইরে চলত খুনোখুনি। হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের সেই রাজনীতির অবসান হয়েছে। বাংলাদেশকে আজকের গণতান্ত্রিক ও উন্নয়ন ধারায় এনেছেন শেখ হাসিনা। তিনি হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির চির-অবসান ঘটিয়েছেন। জ্বালিয়েছেন প্রত্যাশার আলো। এই আলোর ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখতে হবে। ধরে রাখতে হবে অব্যাহত উন্নয়ন। কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, মহলের কারণে সুন্দর আগামীর ব্যত্যয় ঘটতে দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। অতীত নয়, বর্তমান ভাবনায় এগিয়ে নিতে হবে সুন্দর আগামীর বাংলাদেশকে।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন । সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন